বাঙালি মুসলমান নারী জাগরণের পথিকৃৎ হিসেবে পরিচিত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের দেওয়া পোস্ট নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা চলছে।
সম্প্রতি নিজের ফেসবুক পোস্টে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের লেখা 'রোকেয়া রচনাবলী' থেকে খণ্ডিত আকারে কিছু উক্তি তুলে ধরেন রাজশাহী বিশবিদ্যালয় পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক খন্দকার মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসান।
যার শুরুতে শিরোনাম আকারে লেখেন "আজ মুরতাদ কাফির বেগম রোকেয়ার জন্মদিন"।
সামাজিক মাধ্যমে মুহূর্তেই ভাইরাল হয় পোস্টটি। ধর্ম এবং নারীর স্বাধীনতা নিয়ে নানা মন্তব্য করতেও দেখা যায় অনেককে। অনেকেই প্রশ্ন তোলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ধর্মের লেবাসে কীভাবে নারী বিদ্বেষ ছড়ান?
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষক অবশ্য বলছেন, ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে বেগম রোকেয়ার ধর্মীয় অবস্থানটাই সবার সামনে তুলে ধরেছেন তিনি, কাউকে অবমাননা করে বক্তব্য দেননি।
তবে বাংলাদেশের নারী জাগরণে বেগম রোকেয়ার অবদানকে স্মরণ করে রাষ্ট্র যখন আলাদা দিবস পালন করছে তখন তাকে নিয়েই একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের এমন বক্তব্য রাষ্ট্র কীভাবে দেখছে সেটিও জানতে চান কেউ কেউ।
সমাজ বিশ্লেষক ও নারী অধিকারকর্মীদের অনেকেই বলছেন, বাংলাদেশে নারী স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যারা মতাদর্শ দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে তাদের কাছে বড় ভয়ের কারণ বেগম রোকেয়া। আর এ কারণেই তার মৃত্যুর প্রায় শত বছর পরও বারবার নানাভাবে তাকে আক্রমণ করা হয়।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বেগম রোকেয়াকে ঘিরে এর আগেও বিতর্ক তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে।
গত বছরের ১৯শে নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন নাহার হলের সামনের দেয়ালে বেগম রোকেয়ার একটি গ্রাফিতি'র চোখ ও মুখ কালো রঙের স্প্রে দিয়ে ঢেকে দেয় ওই হলেরই একজন শিক্ষার্থী।
এর কয়েকদিন আগে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে 'রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়' করার দাবি জানায় ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী।
নারী অধিকারের প্রশ্ন কেন আসছে
নিজের ফেসবুক পোস্টে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন লেখা 'রোকেয়া রচনাবলী' থেকে ধর্মগ্রন্থ এবং নারী বিষয়ক লেখাগুলোকেই উল্লেখ করেছেন রাজশাহী বিশবিদ্যালয় পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক খন্দকার মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসান।
মূলত 'সাজিদ হাসান' নামের একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্টে 'রোকেয়ার জন্মদিন 'উদযাপন'-এ ইসলাম নিয়ে তার বিশেষ উক্তিগুলো-' এই শিরোনামে মূল পোস্টটি দেওয়া হয়েছে, যার লিংক নিজের পোস্টের সঙ্গে যুক্ত করেছেন মি. হাসান।
তার মতে, নিজের লেখনির মাধ্যমে ধর্মগ্রন্থকে অস্বীকার করেছেন বেগম রোকেয়া।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, "কেউ যদি মনে করে যে বেগম রোকেয়াকে তারা অনুসরণ করবে, উনাকে আদর্শ মানবে এসব নিয়ে তো আমার কোনো বক্তব্য নেই।"
তবে সামাজিক মাধ্যমে তার এই পোস্টের পেছেনে ধর্মের ওপর ভিত্তি করে নারী শিক্ষা, নারীর স্বাধীনতা, নারী স্বাতন্ত্র্য রক্ষার বিষয়টি ঘিরে একটি রাজনৈতিক চিন্তা সামনে আনা হয়েছে বলেই মনে করেন নারী অধিকারকর্মীরা।
তাদের কেউ কেউ বলছেন, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর থেকেই নারীদের প্রতি বিদ্বেষ ও বৈষম্য প্রতিষ্ঠান একটি অপচেষ্টা করছে একটি মহল। যারা নারী জাগরণের পথিকৃত বেগম রোকেয়ার লেখা থেকে খণ্ডিত বক্তব্য সামনে এনে বিভ্রান্তি তৈরির চেষ্টা করছে বলেও মনে করেন তারা।
নারী অধিকার সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলছেন, ধর্মের অপব্যাখ্যার ওপর ভর করে নারীদের সামনে এগোনোর পথে বাধা তৈরি করতে চায় একটি পক্ষ।
"নারী মুক্তির যে স্বপ্ন বেগম রোকেয়া দেখিয়ে গেছেন, তার আদর্শ এখনো প্রাসঙ্গিক হওয়ায় একটি গোষ্ঠী তাকে ভয় পায়। আর এই কারনেই ধর্মের নামে অপব্যাখ্যা সামনে আনার চেষ্টা করে তারা," বিবিসি বাংলাকে বলেন তিনি।
এছাড়া প্রগতির পক্ষের আদর্শকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য একজনকে দাঁড় করানোর চেষ্টা চলছে বলেও মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক সামিনা লুৎফা।
"ধর্মের ভেরতে থেকেই নারীর অধিকারটুকু চেয়েছিলেন তিনি। মৃত্যুর প্রায় একশ বছর পরেও আর আদর্শ প্রাসঙ্গিক বলেই ওনাকে এরকম গালাগাল করতে হয়," বলেন তিনি।
একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিজের লেখায় ট্যাগিংয়ের মাধ্যমে বিদ্বেষ ছড়িয়েছেন বলেও মনে করেন মিজ লুৎফা।
"পিতৃতান্ত্রিক পুরুষদের জন্য এখনো মাথাব্যাথার কারণ রয়ে গেছেন রোকেয়া, এটাই তার স্বার্থকতা," বলেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যা বলছে
বাঙালি লেখক, শিক্ষাবিদ এবং নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার অবদানকে স্মরণ করে তার জন্ম ও মৃত্যুদিন, নয়ই ডিসেম্বর, "রোকেয়া দিবস" হিসেবে পালন করা হয়। বাংলাদেশে সরকারিভাবে পালিত একটি জাতীয় দিবসও এটি।
প্রতি বছরের মতো এবারও সরকারিভাবে পালিত হয়েছে দিবসটি। নারীশিক্ষা, নারী অধিকার, মানবাধিকার ও নারী জাগরণে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে চারজন নারীর হাতে বেগম রোকেয়া পদকও তুলে দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
একই দিকে ফেসবুকে এই পোস্টটি দিয়েছেন রাজশাহী বিশবিদ্যালয় শিক্ষক খন্দকার মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসান, যা নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়।
যার অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে রাষ্ট্র দিবস পালন করে তাকে নিয়েই একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের এমন মন্তব্য অপরাধের সামিল কি না এমন প্রশ্নও তুলেছেন সমাজ বিশ্লেষক ও নারী অধিকারকর্মীদের অনেকে।
নারী অধিকার সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলছেন, রাষ্ট্র স্বীকৃত একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে এমন বক্তব্য দেওয়ায় তার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া উচিত।
"যাকে অনুসরণ করে কোটি নারী সামনে এগোনোর আত্মবিশ্বাস পায়, রাষ্ট্র পদক দেয়, তাকে নিয়ে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক এমন পোস্ট দিতে পারেন কি না এটাও দেখা দরকার। আমরা তো দেখি ফেসবুকে পোস্ট দিলে নানান রকমের মামলা হয়," বলেন মিজ বানু।
বেগম রোকেয়াকে নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মি. হাসানের বক্তব্য তার 'ব্যক্তিগত' বলেই মন্তব্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের।
উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) মোহাম্মদ মাইন উদ্দীন বলছেন, "আমাদের ভিসি স্যারও বলেছেন এটা ওনার ব্যক্তিগত মন্তব্য। এটা ঠিক না আরকি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও এটি পছন্দ করছে না।"
যদিও সামাজিক মাধ্যমে দেওয়া পোস্টের এই বিষয়টি নিয়ে লিখিত অভিযোগ আসলে এ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানান বিশ্ববিদ্যালয়ে উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) মোহাম্মদ মাইন উদ্দীন।
"সামাজিক মাধ্যমেই বিষটি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচন চলছে, এ সম্পর্কিত অভিযোগ আনুষ্ঠানিকভাবে যদি কেউ আমাদের কাছে দেয় তাহলে আমরা বিষয়টি দেখবো," বিবিসি বাংলাকে বলেন তিনি।
আজও প্রাসঙ্গিক বেগম রোকেয়া
বাঙালির আধুনিক যুগের ইতিহাসে যে নারীর নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয় তিনি রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন– বেগম রোকেয়া হিসেবে তিনি অধিক পরিচিত।
২০০৪ সালে বিবিসি বাংলা একটি 'শ্রোতা জরিপ'-এর আয়োজন করে। বিবিসি বাংলার সেই জরিপে শ্রোতাদের মনোনীত শীর্ষ কুড়িজন বাঙালির তালিকায় ষষ্ঠ স্থানে আসেন বেগম রোকেয়া।
ধর্মীয় প্রতিবন্ধকতা আর সামাজিক কুসংস্কারে লড়াই করে বেগম রোকেয়া বাংলার মুসলিম নারী সমাজে শিক্ষার বিস্তার করেছিলেন।
বেগম রোকেয়ার জন্ম ১৮৮০ সালের নয়ই ডিসেম্বর রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে এক অভিজাত পরিবারে। মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে তার পরিবার ছিল খুবই রক্ষণশীল।
সেসময় তাদের পরিবারে মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর কোনও চল ছিল না। আর তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় ঘরের বাইরে গিয়ে মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভেরও কোনও সুযোগ ছিল না।
শিশু বয়সে মায়ের সঙ্গে কলকাতায় বসবাসের সময় তিনি লেখাপড়ার যে সামান্য সুযোগ পেয়েছিলেন, তা সমাজ ও আত্মীয়স্বজনের সমালোচনায় বেশিদূর এগোতে পারেনি, যদিও ভাইবোনদের সমর্থন ও সহযোগিতায় তিনি অল্প বয়সেই আরবী, ফারসি, উর্দু ও বাংলা আয়ত্ত করেছিলেন।
বিহারের ভাগলপুরে স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বিয়ের পর তার জীবনে নতুন এক অধ্যায়ের শুরু হয়েছিল।
স্বামীর সহায়তায় তিনি আরও পড়াশোনা করেন এবং পরে সাহিত্যজীবন শুরু করেন। স্বামীর মৃত্যুর পর লেখালেখির বাইরে সমাজে বদল এবং নারীশিক্ষার বিস্তারে কাজ করেন তিনি। বিবিসি বাংলা
রেডিওটুডে নিউজ/আনাম

