প্রতিকী ছবি
ব্যাংকার ফিরোজ ভুইয়া মরেও অমর হয়ে গেলেন। অখ্যাত থেকে হয়ে গেলেন খ্যাত। তার এই খ্যাতি এখন বিড়ম্বনা হয়ে ঘুরছে মানুষের মুখে মুখে। বেঁচে থাকতে আমাদের কাছে এই নামটি একেবারেই অজানা ছিলো। অথচ মরার পর এখন তাকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এই আলোচনা যতটা না গৌরব আর সম্মানের তার চেয়ে বেশি অমানবিক ও অসম্মানের। প্রার্থণা করি যেন এমন আলোচনা আর কাউকে নিয়ে না হয়। কাউকে নিয়ে যেন লিখতে না হয় এমন অমানবিক গল্প।
গণমাধ্যমের সুবাদে ইতোমধ্যে খবরটি সবার জানা। তারপরও একটু সংক্ষেপে ঘটনাটি বলি। নরসিংদীর ফিরোজ ভুইয়া। পেশাগত জীবনে ছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তা। রাজধানীর বাড্ডায় পাঁচতলা বাড়ি। ব্যাংকে কোটিরও বেশি টাকা। রয়েছে নরসিংদীতেও একটি একতলা বাড়ি। গত শুক্রবার মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুকে হত্যাকান্ড বলেও দাবি করা হচ্ছে। এ অভিযোগের তীর তার ছোটো ছেলে আবীর ভুইয়ার দিকে। বড় ছেলে তানভীর কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন হওয়ায় সব সম্পত্তি ছোটো ছেলে নিয়ে নিয়েছেন জোর করে, কৌশলে। শেষ পর্যন্ত তার মৃত্যুর পর সম্পদের ভাগবাটোয়ারা সংক্রান্ত জটিলতা না মেটায় নিজ বাড়ির নিচেই পচতে হয়েছে ফিরোজ ভুয়াকে। ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে লাশের কাছে কেউ ছিলো না। এসময় বাড়ির কুকুরটি তাকে পাহারা দিয়েছে। দুইদিন পর এলাকাবাসী চাঁদা তুলে ফ্রিজিং ভ্যানে করে তাকে পাঠিয়ে দেয় গ্রামের বাড়ি। সেখানেই দাফন হয় ফিরোজ ভুইয়ার।
গণমাধ্যমের খবর বলছে, এর আগে ব্যাংক ঋণ তোলার নাম করে বাবার কাছ থেকে কৌশলে বাড্ডার বাড়ির দলিল নেয় আবির ভুইয়া। এ কাজে তাকে সহায়তা করেছে স্ত্রী ও শ্বশুর। শেষ বয়সে তাকে আটকে রাখা হতো বাড়ির একটি প্রায় পরিত্যাক্ত ঘরে। খাবার দেওয়া হতো না। হাঁটাচলা করতে দেওয়া হতো না। শারীরিক নির্যাতনও করা হতো। এই অবস্থায় দীর্ঘদিন ভুগে শেষমেষ অত্যন্ত নির্মমভাবে দুনিয়া ত্যাগ করতে হলো এই ব্যাংক কর্মকর্তাকে।
আমাদের সমাজে এ ধরণের ঘটনা বাড়ছে। সম্পত্তির লোভে পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন হচ্ছে। ভাইয়ে ভাইয়ে বিবাদ-খুনোখুনি হচ্ছে। বাবা-মাকে নির্যাতন করার ঘটনা ঘটছে। শরীক ঠকিয়ে নিজেই সকল সম্পদের মালিক কিভাবে হওয়া যায় তা নিয়ে কূট-কৌশলের মাত্রা বাড়ছে। সবমিলে আমরা এখন এক মনস্তাত্ত্বিক পূঁজিপতি জাতি। পূঁজিবাদ যে কেবল রাষ্ট্রেই ঘটে চলেছে তা নয়। এখন এর অনুশীলন বেশ জোরেশোরেই হচ্ছে আমাদের পরিবারে।
নিজ সন্তানের নির্যাতনে এমন নির্মম মৃত্যুর পর বিভিন্ন মহল থেকে ধিক্কার উঠছে। মৃতের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে ছোটো ছেলে আবীরের ওপর মানুষের ঘৃণা উপচে পড়ছে। তার বিচারের দাবি করেছেন এলাকাবাসী। সেইসঙ্গে সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করে স্ত্রীর ভরণ পোষণ ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবিও করছেন অনেকে। ফিরোজ ভুইয়ার স্ত্রীর দাবি ছোটো ছেলে আবীর ভুইয়া নির্যাতনকারী। বাবাকে সে নির্যাতন করে মেরে ফেলেছে। তাকেও এমন পরিণতি বরণ করতে হতে পারে এমন আশঙ্কায় আতঙ্কে দিন কাটছে অন্যের বাসায়। আর বড় ছেলে অসুস্থ তানভীরের ভাষ্য আগে থেকে সম্পদ ভাগ না করে দেওয়ায় এমনটা হয়েছে। ছোটো ভাই সব সম্পত্তি দখল করলেও বাবা-মায়ের দেখাশোনা করেনি। বরং নির্যাতন করেছে। এই অবস্থায় তার অসহায়ত্বের কথাও বলেছেন তিনি। এই যে পারিবারিক টানাপড়েন,দ্বন্দ্ব, সংঘাত। এর জন্য কি কেবলই সন্তানেরা দায়ি? আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা, পুঁজিপতি অর্থনীতি কিংবা খোদ বাবা-মায়েরাও কি এর জন্য দায়ি নয়?
প্রিয় পাঠক, বিষয়টি শুনতে একটু খটকা লাগলেও একে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না যে, আমরা রাষ্ট্রের সামগ্রিক অবস্থার দ্বারা প্রভাবিত হই। আমাদের মনস্তত্বে সামাজিক অবক্ষয় কিংবা অসুস্থ প্রতিযোগিতাও প্রভাব ফেলে। আমরা রাষ্ট্রের অর্থ ব্যবস্থার আলোকে দিনকে দিন পরিবর্তিত হই। একথা অস্বীকার করা যাবে না যে, গত দেড় দশকে আমাদের রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যবস্থায় একটি নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে। যে ব্যবস্থায় সমতার নীতি নেই। ব্যক্তি আয় গড়ে বাড়লেও জনে বাড়েনি। অর্থাৎ মাথাপিছু আয় বেড়েছে। কিন্তু প্রতিটি মাথা তার আয়ের ভাগ বুঝে পায়নি। একটি শ্রেণির আয়ের পরিমান এতোটাই বেড়েছে যে তা সামগ্রিক ভাবে আমাদের অর্থনীতিকে বড় করেছে। কিন্তু আদপে আমরা সবাই সমানভাবে একসাথে বড় হইনি। যারা বড় হয়েছে তাদের ভূমিকা এখানে ঠিক আবির ভুইয়ার মতোই। অর্থাৎ কোনো না কোনো ভাবে তারা অন্যের অর্থে, অন্যের আয়ের হিসাব কেড়ে নিয়ে বড় হয়েছেন। ফলে একটি অস্বাভাবিক অর্থ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে আমাদের চারপাশে। এই অবস্থা আমাদেরকে হতাশাগ্রস্থ করছে। আমাদেরকে ভাবিয়ে তুলছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেটি আমাদেরকে অন্যের হক ঠকিয়ে পাপী হতেও প্ররোচিত করছে। আমরা সেই প্ররোচনায় পড়ে রাতারাতি বড় লোক হবার স্বপ্নে বিভোর হচ্ছি। এক্ষেত্রে যাদের সুযোগ রয়েছে তারা রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটে নিচ্ছি। যাদের সঙ্গতি রয়েছে তারা শিল্প মালিকানার ছদ্মাবরণে মুনাফা লুটে টাকার পাহাড় গড়ছি। আর যাদের এসবে ভাগ বসানোর ক্ষমতা নেই তারা নিজ পরিবারে ভাগ বসাচ্ছি। এটি করতে গিয়ে ভাই-বোনকে বঞ্চিত করছি। বাবা-মাকে জিম্মি করছি। সবকিছুই মূলত নিজেকে পুঁজিপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস।
ফিরোজ ভুইয়ার মতো আমাদের সমাজে এমন অসংখ্য বাবা রয়েছেন যারা জীবনে অনেক কষ্ট করেই কিছু টাকার মালিক হন। সন্তানদের লেখাপড়া করান। মূলত এইসব সন্তানদের সুখের কথা ভেবেই শরীরের রক্ত পানি করে টাকা উপার্জন করেন এসব বাবারা। এটি করতে গিয়ে জীবনে অনেক সখ-আহ্লাদকে বিসর্জন দেন। অনেক স্বপ্ন অধরা রেখেই পরপারে পাড়ি জমান। কিন্তু যাবার আগে সন্তানদের মধ্যে সেই সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন করে যান না। সবাইকে ভাগ করে দিলে শেষ বয়সে না জানি তাকে কোন দুর্দশা গ্রাস করে এমন ভয়েই হয়তো হাতের পাঁচ তারা ছাড়তে চান না। তাই অনেক ক্ষেত্রেই মৃত্যুর পর এ নিয়ে ব্যাপক ঝামেলার সৃষ্টি হয়। কখনো কখনো ভাইয়ে ভাইয়ে খুনোখুনিও হতে দেখা যায় এই অমিমাংসিত বিষয়ের মিমাংসা নিয়ে।
আবির ভুইয়া এখানে একটি নির্মমতার উদাহরণ এটি অস্বীকারের কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু এই নির্মমতাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য আমাদেরও কি দায় নেই? সে বিষয়টি হয়তো আমাদের ভেবে দেখা হয়নি। তা না হলে এমন সন্তানকে যে শিক্ষায় শিক্ষিত করছি সেই শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কেন আমরা প্রশ্ন করি না। যেই শিক্ষায় শিক্ষিত করতে গিয়ে বাবা-মায়েরা তাদের সম্পদের বিশাল একটি অংশ কী অবলিলায় নষ্ট করি অথচ একবারও বুঝতে চাইনা এই শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সন্তানরা পুঁজিপতি মানসিকতার হবে না তো? তথা কথিত শিক্ষিত সন্তানরা কুসন্তান হলে তখন বাবা-মায়েদের অবস্থা কোথায় গিয়ে ঠেকবে সেটিও আমাদের ধারণার বাইরে রয়ে যায়।
মানুষ গড়ার পরিবর্তে যে শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের সন্তানদের সম্পদমুখী করে তুলছে সেটি আসলেই কোনো শিক্ষা নয়। সেটি টাকা বানানোর মেশিন। যেই মেশিনের ভেতরে রক্ত মাংস নেই। হৃদয় তো দূরের কথা স্পর্শের অনুভূতিও তাদের থাকে না। সে কেবলই কিছু কলকব্জার সমাহার। তাই এই টাকা বানানোর মেশিনের কাছ থেকে নিশ্চয়ই আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ কিংবা মানবিক আচরণ পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তারা আমাদের প্রতি নিষ্ঠুরতাই ফিরিয়ে দেবে।
পবিত্র কোরআনে পিতা-মাতার অধিকারের কথা বলা হয়েছে। তাদের যেন মুখে ‘উফ’ শব্দটিও উচ্চারণ করতে না হয় এমন পরিবেশ সৃষ্টি না করতেও সন্তানদের প্রতি কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এটি হলো সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার হক। কেবল জন্মদাতা-জন্মদাত্রী বলেই এই অধিকার তারা ভোগ করবেন। এইখানে কোনো শিথিলতার স্থান নেই।
পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্বের কথা আমরা সবাই জানি। সেইসঙ্গে সন্তানের প্রতি পিতামাতার দায়িত্বের কথাও নিশ্চয়ই জেনে থাকবো। আদর্শ ও মানবিক গুনাবলী সম্পন্ন মানুষ হিসেবে সন্তানদের গড়ে তুলতে মাতা-পিতার যতœ আদর ও ভালোবাসার দুয়ার সর্বদা খোলা রাখতে হবে।
আমাদের সমাজে অনেক বাবা-মা ই রয়েছেন যারা সন্তানের দু:সময়ে পাশে দাড়ান না। কিংবা একাধিক সন্তানের ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্ব করেন। বুঝে হোক কিংবা না বুঝে বা অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এমন পক্ষপাতিত্ব সন্তানকে বিপথে নিতে অনেক সময়ই প্ররোচিত করে। অনেক বাবা-মার সামর্থ্য থাকলেও সন্তানের দু:সময়ে সামর্থ্য অনুযায়ি পাশে না দাড়িয়ে কেবল আল্লাহর নিকট দোয়া করে থাকেন। এসব কিছুতেই মূলত এ ধরণের পক্ষপাতিত্ব থাকে।
ফিরোজ ভুইয়ার জীবনের শেষ সময়টা কষ্টে কেটেছে। সন্তানের নির্যাতন, সম্পদ থাকতেও মানবেতর জীবন যাপন করতে হয়েছে। এটি আমাদের বাবা-মায়েদের জন্যও এক ধরণের শিক্ষা। কষ্টার্জিত সম্পদকে মৃত্যুর সময় সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া যাবে না। কেননা কাফনের তো পকেট নাই। তাই এই সম্পদ যাতে ওয়ারিশদের মধ্যে ইনসাফ মোতাবেক ভাগ করে রেখে যাওয়া যায় সে উদ্যোগ আগে ভাগেই নিতে হবে। তারও আগে যে সন্তানের জন্য চোখ-কান বুজে, হালাল-হারামের চিন্তা না করে অর্থ উপার্জন করছেন তাদের সত্যিকারের মানুষ বানাতে পারছেন কি না সেটি নিশ্চিত করতে হবে। আপনি চেষ্টা করবেন, নিয়ত সহি থাকলে আল্লাহই আপনাকে সাহায্য করবেন। সন্তানদের সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারলে, তাদের ভেতর নৈতিক বোধ, মানবিক চেতনার বিকাশ ঘটাতে পারলে আশা করা যায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে না। আল্লাহ আমাদের বাবা-মায়ের প্রতি দায়িত্ব পালনের পূর্ণ সক্ষমতা দান করুন। সেইসঙ্গে প্রত্যেকটি বাবা-মাকে তাদের সন্তানের প্রতি কর্তব্যবোধকে সহিহ করুন। আমীন।
লেখক: সাংবাদিক, কথাশিল্পী।
রেডিওটুডে নিউজ/এমএস

