
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিলসহ বিভিন্ন দাবিতে গতকাল রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করে হেফাজতে ইসলাম।
গণহত্যার দায়ে আওয়ামী লীগের বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত দলটিকে নিষিদ্ধ করা, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিলসহ ১২ দফা দাবি জানিয়েছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। বর্তমান সরকার এসব দাবি না মানলে রাজপথে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলার হুঁশিয়ারি দিয়েছে সংগঠনটি।
গতকাল শনিবার দুপুরে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চার দফা দাবিতে আয়োজিত মহাসমাবেশ থেকে এসব ঘোষণা দেওয়া হয়।
১২ দফা দাবিসংবলিত ঘোষণাপত্র পাঠ করেন হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির মাওলানা মাহফুজুল হক।
ঘোষণাপত্রে বলা হয়, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন ও তাদের প্রতিবেদন অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। একই সঙ্গে আলেম-ওলামাদের পরামর্শে ধর্মপ্রাণ নারীসমাজের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করে নতুন কমিশন গঠন করতে হবে; সংবিধানে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃস্থাপন করতে হবে; বহুত্ববাদ বাদ দিতে হবে, এলজিবিটি ও ট্রান্সজেন্ডারদের স্বীকৃতি বন্ধ করতে হবে; আল্লাহ ও রাসুল (সা.)-এর নামে কটূক্তি ও বিষোদগার বন্ধে সর্বোচ্চ শাস্তির আইন করতে হবে; গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে ধর্ম অবমাননার শাস্তিসংক্রান্ত আইনি ধারাগুলো বাতিল করতে হবে; চট্টগ্রামের ইসকন সদস্য চিন্ময় দাসের জামিন প্রত্যাহার করতে হবে; ফ্যাসিস্ট হাসিনার শাসনামলে আলেম-ওলামা ও মাদরাসা শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দেওয়া মামলা প্রত্যাহার বা নিষ্পত্তি করতে হবে; গাজার মুসলমানদের ওপর গণহত্যা ও ভারতে সংখ্যালঘু মুসলিম নির্যাতনের বিরুদ্ধে সরকারকে কূটনৈতিকভাবে আরো উচ্চকণ্ঠ হতে হবে; শাপলা চত্বর ও জুলাই আন্দোলনের গণহত্যার বিচারে গতি আনতে ট্রাইব্যুনালের সক্ষমতা আরো বাড়াতে হবে; জাতীয় নির্বাচনের আগেই ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তাঁর চিহ্নিত দোসরদের বিচার সম্পন্ন করতে হবে; গণহত্যাকারী ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগকে সন্ত্রাসী দল হিসেবে ঘোষণা করে বিচার করতে হবে, দলটির বিচার সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তাদের সব ধরনের কার্যক্রম ও তৎপরতা নিষিদ্ধ করতে হবে; শিক্ষার সর্বস্তরে ইসলামী শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে; রাখাইনকে ‘মানবিক করিডর’ দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরকারকে ফিরে আসতে হবে; চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে ভিনদেশি মিশনারিদের অপতৎপরতা ও দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে; সেখানে সামরিক নিরাপত্তাব্যবস্থা আরো বাড়াতে হবে; কাদিয়ানিদের রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘অমুসলিম’ ঘোষণা ও তাদের অপতৎপরতা বন্ধ করতে হবে।
সমাবেশে হেফাজতে ইসলামের আমির মুহিববুল্লাহ বাবুনগরীর পক্ষে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংগঠনটির যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক। এতে বলা হয়, ‘আমাদের দেশ এখন বহুমুখী সংকটে রয়েছে।
সেই সঙ্গে আগ্রাসী ভারতের ষড়যন্ত্রও থেমে নেই। উপরন্তু মানবিক করিডরের নামে সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের ভূ-রাজনৈতিক লড়াইয়ের স্বার্থে আমাদের জন্মভূমি বাংলাদেশকে নতুন যুদ্ধের ক্ষেত্র বানাতে পরিকল্পনা করে যাচ্ছে। এই বাংলাদেশ নিয়ে আধিপত্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্র ঠেকাতে এবং দেশের অভ্যন্তরীণ নানা সংকট মোকাবেলায় আমাদের জুলাই-আগস্টের মতো ইস্পাত কঠিন জাতীয় ঐক্য, সংহতি আবারও গড়ে তুলতে হবে।’
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন নিয়ে তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারকে আমরা হুঁশিয়ার করে বলতে চাই, এনজিওবাদী গোষ্ঠীর প্ররোচনায় এমন কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত নেবেন না, যা কোরআন-সুন্নাহর বিরুদ্ধে যায়।
এ ক্ষেত্রে আমরা কোনো ছাড় দেব না। এই বিতর্কিত কমিশন ও কোরআনবিরোধী প্রতিবেদন অবিলম্বে বাতিল করুন। হেফাজতে ইসলাম নারীর ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে। আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি, দেশের যৌতুকপ্রথা বন্ধে কঠোর আইন করুন। শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন।
আমরা এমন বাংলাদেশ গড়তে চাই, যেখানে সংখ্যালঘুসহ সব নাগরিকের জান-মালের নিরাপত্তা, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও ধর্ম পালনের অধিকার সুরক্ষিত থাকবে। কথা বলার স্বাধীনতা থাকবে। নাস্তিকতা ও মুক্তমনা চর্চার নামে কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার সুযোগ থাকবে না। সংখ্যালঘুদের রাজনীতির বলির পাঁঠা বানানো যাবে না। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এমন একটি বিভেদমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা আমাদের প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যেখানে কাউকে গুম-খুন, জেল-জুলুম ও পুলিশি নির্যাতন করা হবে না। গণহত্যার বিচারের পাশাপাশি ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দালালদেরও বিচার করা হবে।
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক বলেন, ‘নারী সংস্কার কমিশন বিতর্কিত। তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ তারা দেশের মানুষের মূল্যবোধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। নারী সংস্কারের নামে ইসলামকে কটূক্তি করা হয়েছে। হেফাজত সব সময় নারীদের সম্মান দেয়। সংবিধানে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা বাস্তবায়নে প্রয়োজনে আবারও রাজপথে নামব।’
তিনি বলেন, ‘আলেমদের বিরুদ্ধে বিগত ফ্যাসিস্টদের আমলে দায়ের করা মামলা আগামী দুই মাসের মধ্যে প্রত্যাহার করতে হবে। না করলে আমাদের যা করার করব।’
একই অনুষ্ঠানে তাহরিকে খতমে নবুওয়াত বাংলাদেশের আমির ড. মাওলানা এনায়েতুল্লাহ আব্বাসী বলেন, বাকস্বাধীনতার নামে যেই ইসলামের বিরোধিতা করবে, তাকে আইনের আওতায় আনতে হবে। জঙ্গি তকমা দিয়ে আমার দেশের আলেম-ওলামাদের কারাগারে রাখা হয়েছে। বাবর সাহেব যদি মুক্তি পান, তাহলে জঙ্গির মামলায় আলেম-ওলামারা কেন মুক্তি পাবেন না।
তিনি বলেন, ‘নারীবিষয়ক বিতর্কিত সংস্কার কমিশন গঠন করে আমাদের দৃষ্টি ভিন্নদিকে প্রবাহিত করা হচ্ছে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিক্রির সওদাবাজি হচ্ছে কি না তা-ও দেখতে হবে। ড. ইউনূস সাহেব অবস্থান পরিষ্কার করুন। মানবিক করিডরের নামে বাংলাদেশকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের যুদ্ধ ঠেলে দেবেন না। আমরা ভারতকে শায়েস্তা করেছি। যদি আটলান্টিকের ওপার থেকে কেউ আগ্রাসন চালাতে আসে, তাহলে বাংলাদেশের প্রতিটি মাদরাসা হবে একেকটি ক্যান্টনমেন্ট।’
আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘হেফাজতে ইসলাম নারীবাদ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। আমি এখানে ড. ইউনূস সরকারের প্রতি প্রশ্ন করতে চাই, আপনারা কেন অপ্রয়োজনীয় ইস্যু তৈরি করছেন? নারী কমিশন তৈরির জন্য জুলাই বিপ্লবে কেউ জীবন দেয়নি। তারা জীবন দিয়েছিল এ দেশ থেকে ফ্যাসিবাদ মুক্ত করার জন্য। কাজেই আপনারা সরকারে বসেছেন, যাতে বাংলাদেশে আর ফ্যাসিবাদ ফিরে আসতে না পারে। বাংলাদেশের একজন প্রবীণ নাগরিক হিসেবে আমার অনুরোধ, আপনারা অপ্রয়োজনীয় ইস্যু তৈরি করবেন না। আপনারা অনেক সংস্কার কমিশন করেছেন, যেগুলোর কোনো প্রয়োজনই ছিল না। আপনারা রাষ্ট্রের সময় এবং সম্পদ নষ্ট করছেন।’
তিনি বলেন, ‘আমি একটা বিষয় দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি, হেফাজতের পক্ষ থেকে কেন এত দিনেও দানব ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়নি! শাপলা চত্বরে যতজন নিহত হয়েছে, তাদের সবার হয়ে গণহত্যার দায়ে হাসিনার নামে মামলা করতে হবে।’
অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ, হেফাজতে ইসলামের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ আল হাবীব, সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা খলিল আহমেদ কোরাইশীসহ দেশের শীর্ষ আলেম, মাওলানা, মুফতি, উলামায়ে কেরাম ও বিভিন্ন মাদরাসার শিক্ষার্থীরা।
রেডিওটুডে নিউজ/আনাম