
শাংহাই থেকে প্রায় ৪০ মাইল দূরে, চ্যচিয়াং প্রদেশের হ্যাংচৌ উপসাগরের শেংশান দ্বীপে লুকিয়ে আছে এক বিস্ময়কর গ্রাম—হোথোউওয়ান। একসময় এটি ছিল মৎস্যগ্রাম। হাজারো মানুষ মাছ ধরে সংসার চালাতো, আর ছোট্ট এই দ্বীপজুড়ে ভেসে বেড়াত কোলাহল ও সমুদ্রের সুর। কিন্তু সময়ের নিয়মে সেই প্রাণবন্ত গ্রাম এখন যেন প্রকৃতির আঁচলে হারিয়ে গেছে। ভাঙা দেয়াল জড়িয়ে ধরেছে লতা-পাতা, সরু মাটির পথ ঢেকে গেছে ঘাসে, আর ঘরের ভেতরে পড়ে থাকা পুরোনো আসবাবপত্র যেন কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
১৯৮০ সালের দিকে হোথোউওয়ানে তিন হাজারের বেশি মানুষ বসবাস করত। মাছ ধরা ছিল জীবিকা নির্বাহের মূল ভরসা। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে শাংহাইয়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতা, দূরত্ব এবং দুর্গম যাতায়াতের কারণে মানুষ ধীরে ধীরে গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। শেষ পর্যন্ত ২০০২ সালে সরকার হোথোউওয়ানকে আনুষ্ঠানিকভাবে জনশূন্য গ্রাম ঘোষণা করে।
মানুষ সরে যাওয়ার পর গ্রামকে ঘিরে ধরে নিসর্গের রাজত্ব। একে একে ভেঙে পড়েছে অনেক বাড়ির দেয়াল, আবার কিছু বাড়ি ঢেকে গেছে সবুজের আস্তরণে। ভাঙা ছাদের ভেতর দিয়ে রোদ ঝরে পড়ে, জানালার গায়ে জড়িয়ে থাকে বুনো লতা। গ্রামের সরু পথ দিয়ে হাঁটলে মনে হয় যেন সময় থেমে গেছে কোনো এক জায়গায়। অতীতের কোলাহল মিলিয়ে গিয়ে সেখানে এখন কেবল বাতাসের শব্দ আর প্রকৃতির সঙ্গীত।
২০১৫ সালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গ্রামটির ছবি ভাইরাল হওয়ার পর দুনিয়ার নানা প্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসতে শুরু করে। কুয়াশাচ্ছন্ন দিনে সবুজে ঢেকে যাওয়া গ্রামটি দেখলে মনে হয় যেন কোনো রূপকথার দৃশ্য। পর্যটন চাহিদা বাড়তে থাকায় ২০১৭ সালে সরকার এখানকার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেয়—ভিউয়িং টাওয়ার তৈরি করে, টিকিট ব্যবস্থা চালু করে এবং ভাঙা বাড়িগুলোর বাইরে সতর্কতামূলক সাইন বসায়। এখন প্রতি বছর এক লাখেরও বেশি পর্যটক হোথোউওয়ান দেখতে আসেন। এর ফলে আশপাশের দ্বীপগুলোতেও তৈরি হয়েছে নতুন হোটেল, গেস্টহাউস আর স্থানীয়দের জন্য আয়বাড়ানোর সুযোগ।
শাংহাই থেকে হোথোউওয়ান যেতে সময় লাগে ৪–৬ ঘণ্টা। তাই একদিনে গিয়ে ফিরে আসা প্রায় অসম্ভব। অন্তত এক বা দুই রাতের পরিকল্পনা করা ভালো। যদিও গ্রামে থাকার ব্যবস্থা নেই, তবে কাছের শেংশান ও কোকি দ্বীপের গেস্টহাউসে আগে থেকেই বুকিং করে নেওয়া যায়। এখানে প্রবেশে টিকিটের মূল্য ৮ ডলার।
এই পুরো গ্রাম ঘুরতে লাগে সময় লাগে প্রায় ১–২ ঘণ্টা। তবে মনে রাখা ভালো, কিছু ভাঙা ঘরের ভেতরে প্রবেশ নিষিদ্ধ এবং কিছু সরু পথও বন্ধ রাখা হয়েছে নিরাপত্তার কারণে।
হোথোউওয়ান শুধু একটি পরিত্যক্ত গ্রাম নয়; এটি প্রকৃতি, ইতিহাস ও মানুষের স্মৃতির মেলবন্ধন। ভাঙা ঘর, লতাঘেরা দেয়াল আর নিস্তব্ধ রাস্তা একসঙ্গে মিলে যেন বলে যায় এক হারিয়ে যাওয়া গল্প। এখানে দাঁড়ালে বোঝা যায়—মানুষের তৈরি সভ্যতাও একদিন প্রকৃতির কাছে হার মানে। আর সেই নীরব সৌন্দর্যেই খুঁজে পাওয়া যায় প্রশান্তি, মুগ্ধতা ও এক ভিন্ন জগতের ছোঁয়া।
হোথোউওয়ান ভ্রমণ মানে কেবল একটি গ্রাম দেখা নয়, বরং সময়ের স্তর পেরিয়ে ইতিহাস, প্রকৃতি আর মানুষের স্মৃতির মিশেলে গড়া এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার যাত্রা।
রেডিওটুডে নিউজ/আনাম