
২,৫০০ বছরের পুরোনো ঐতিহ্যে ভেসে থাকা এক শহর লুচি। চিয়াংসু প্রদেশের সুচৌ শহরের কাছেই অবস্থিত এই শহর। হাজার বছরের পুরোনো এই শহরটিকে বলা হয় 'জলের শহর'। সরু খাল, বাঁকানো পাথরের ব্রিজ, সাদা প্রাচীরের পুরোনো ঘর আর সবুজ পানির ঢেউ—সব মিলিয়ে যেন অন্য এক জগতে পা রাখা। এখানে হাঁটলেই বোঝা যায়, কীভাবে চীন তাদের প্রাচীন ঐতিহ্য আর আধুনিক রূপকে পাশাপাশি বাঁচিয়ে রেখেছে।
লুচির ইতিহাস শুরু খ্রিষ্টপূর্ব ৫১৪ সালে। সে সময় উ রাজ্যের রাজা এখানে তার রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। সেই সময় থেকেই শহরের চারপাশে গড়ে ওঠে খাল, পাথরের সেতু আর মন্দির। আজও সেই ঐতিহাসিক ছাপ দেখা যায় শহরের নানা স্থাপত্যে। পাথরের সেতুগুলোই লুচির প্রাণ।একসময় এখানে শতাধিক সেতু ছিল। বর্তমানে প্রায় ৪০টির মতো সেতু টিকে আছে, যেগুলোর বেশিরভাগই মিং ও ছিং রাজবংশের সময়কার।
লুচিকে বলা হয় 'পূর্বের ভেনিস', কারণ এখানে নৌকাই ছিল প্রধান যাতায়াত মাধ্যম। আজও কাঠের ছোট নৌকায় চড়ে খালের জলে ভ্রমণ করলে মনে হয় সময় পেছনে ফিরে গেছে।
শহরের ভেতরে রয়েছে বাওশান মন্দির , যেখানে ৯ম শতাব্দীর প্রাচীন বুদ্ধমূর্তি সংরক্ষিত আছে। কাঠের খোদাই, পাথরের ভাস্কর্য আর ছাদের রঙিন টালি এখনো দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে।
লুচি শহরের সংস্কৃতির বড় একটি অংশ হলো এখানে তৈরি হওয়া সিল্ক। লুচি ও সুচৌ অঞ্চল চীনের সিল্ক উৎপাদনের জন্য বিশ্বজুড়ে খ্যাত। এখনো পর্যটকরা সিল্ক মিউজিয়ামে গিয়ে সিল্ক তৈরির প্রাচীন কৌশল কাছ থেকে দেখতে পারেন।
লুচি কেবল পুরোনো দিনের স্মৃতি নয়; এখানে যুক্ত হয়েছে আধুনিক আকর্ষণও। থেংওয়াং প্যাভিলিয়নে চালু হয়েছে ডিজিটাল ইমার্সিভ ট্যুর, যেখানে আলোকসজ্জা, সাউন্ড সিস্টেম ও ভার্চুয়াল প্রদর্শনীর মাধ্যমে দর্শকরা পুরোনো দিনের পরিবেশে প্রবেশ করেন। রাতে পুরো শহর রঙিন আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে—যা পর্যটকদের জন্য ভ্রমণের অভিজ্ঞতাকে করে আরও সমৃদ্ধ।
এছাড়া পর্যটন বাড়ানোর জন্য স্থানীয় প্রশাসন নানা অভিনব উদ্যোগ নিচ্ছে। যেমন—প্রবেশমূল্য ছাড়, সাংস্কৃতিক উৎসব আয়োজন এবং স্থানীয় খাবার ও হস্তশিল্পকে ভ্রমণ অভিজ্ঞতার অংশ করে তোলা।
এখানে ভ্রমণকারীদের জন্য থাকছে নৌকাভ্রমণ। খালের ভেতর ছোট নৌকায় চড়ে শহর ঘোরা লুচির প্রধান আকর্ষণ।
আরেকটি আকর্ষণ হচ্ছে পাথরের সেতু। প্রাচীন সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে ছবি তোলাই যেন লুচি সফরের বিশেষ মুহূর্ত।
এখানকার স্থানীয় রেস্টুরেন্টগুলোতে পরিবেশন করা হয় মাছ, নুডলস আর সয়াসসে রান্না করা খাবার। পর্যটক এসব খাবারের অভিজ্ঞতা নিতে পারে খুব সহজেই। এছাড়া সিল্ক, কাঠের খোদাই, আর্টপিস—এসব পর্যটকরা কিনে নিয়ে যেতে পারেন স্মৃতি হিসেবে।
শাংহাই থেকে ট্রেনে বা বাসে সুচৌ পৌঁছে সেখান থেকে মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে লুচি যাওয়া যায়। শহরে ছোট গেস্টহাউস, ঐতিহ্যবাহী চীনা স্টাইলের আধুনিক হোটেল—সব ধরনের থাকার সুযোগ আছে। এখানে ভ্রমনের উপযুক্ত সময় বসন্ত (মার্চ–মে) ও শরৎ (সেপ্টেম্বর–অক্টোবর)। এ সময় আবহাওয়া আরামদায়ক এবং খালের চারপাশে ফুলে-ফলে ভরে যায়।
লুচি কেবল পর্যটনকেন্দ্র নয়; এটি এক জীবন্ত ইতিহাস। এখানে ঘুরে বেড়ালে বোঝা যায় কেমন ছিল প্রাচীন চীনের নগরজীবন। একইসঙ্গে আধুনিক উদ্যোগ ও নতুন প্রযুক্তি ভ্রমণকারীদের অভিজ্ঞতাকে করে তুলছে আরও বর্ণিল।
প্রকৃতি, ইতিহাস, সংস্কৃতি আর আধুনিকতার মেলবন্ধনে লুচি এখন আন্তর্জাতিক পর্যটকদের জন্য এক জনপ্রিয় গন্তব্য। শাংহাই থেকে মাত্র কয়েক ঘণ্টার দূরত্বে এই শহর আপনাকে উপহার দেবে এক ভিন্ন জগতের স্বাদ—যেখানে সময় থেমে গেছে, অথচ জীবন বয়ে চলেছে একইসঙ্গে অতীত ও বর্তমানের ছন্দে।
রেডিওটুডে নিউজ/আনাম