বুধবার,

০৮ মে ২০২৪,

২৫ বৈশাখ ১৪৩১

বুধবার,

০৮ মে ২০২৪,

২৫ বৈশাখ ১৪৩১

Radio Today News

সানি লিওনি পরে আগে নিজেকে সামলান 

মেসবাহ শিমুল, সাংবাদিক 

প্রকাশিত: ১৯:৩৯, ১৮ মার্চ ২০২২

আপডেট: ১৯:৪৪, ১৮ মার্চ ২০২২

Google News
সানি লিওনি পরে আগে নিজেকে সামলান 

ফাইল ছবি

ইউক্রেনের প্রতিরোধ যোদ্ধারা রুশ বাহিনীর মোকাবেলায় অনেকটাই ধরাশায়ী-অসহায়। ঠিক যেমনটি নিত্যপণ্যের সামনে দেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষ। এই মানুষগুলোর না আছে পণ্য কেনার সামর্থ্য না আছে লুটেরাদের প্রতিহত করার শক্তি। ঠিক যেন জেলেনস্কি বাহিনীর মতো কোনো মতে টিকে থাকার চেষ্টা করছে পুতিন বাহিনীর ট্যাঙ্ক, মিসাইল আর ভারি বোমার সামনে। যুদ্ধ ও জীবনযুদ্ধের এমন সঙ্কটময় মুহূর্তে দেশীয় পরনিন্দা মার্কেটে এসেছে নতুন পণ্য। বিশ্বখ্যাত এই পণ্যের নাম  ‘সানি লিওনি’। এ যেন সব পণ্যের সেরা পণ্য। তাই তাকে নিয়ে আমাদের টেনশনের শেষ নেই। শেষ নেই উদ্বেগ-আবেগ আর উত্তেজনারও। 

সানি লিওনি। এক সময়ের পর্ণ তারকা। বিশ্বের টপ র‌্যাকিংয়ের ‘শৈল্পিক সেক্সওয়ার্কার’দের মধ্যে তিনি অন্যতম। এটি তার অতীত জীবন। যতটুকু জানা যায়, এখন তিনি এই জীবন থেকে বেরিয়ে এসেছেন। কাজ করছেন মুম্বাইয়ের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে। তবে মূল ধারার পেশায় ফিরলেও বাংলাদেশের মানুষের মনোজগতে এখনো তার পরিচয় একজন ‘সানি লিওনি’ হিসেবেই। যিনি কেবলই একজন পর্ণস্টার। তাই তাকে নিয়ে আমাদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার যায়গাটা একটু ভিন্ন। 

সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণমন্ত্রী যদিও তাকে নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। তার বক্তব্য- সানি লিওনিকে দেশে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি। তার ‘ভিসা বাতিল’ করা হয়েছে। যদিও ভিসা বাতিলের সঙ্গে ওই মন্ত্রণালয় কিংবা মন্ত্রীর কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে বলে আইন কিংবা যুক্তি কোনোটিই সমর্থন করে না। তবে এটি ঠিক যে একটি সিনেমায় অভিনয়ের জন্য সানি লিওনির নাম থাকায় সেটি থেকে তার ‘ওয়ার্ক পারমিট’ বাতিল করা হয়েছে। আর ওয়ার্ক পারমিট বাতিল করা মানে ভিসা বাতিল করা নয়। অতএব সানি লিওনি বাংলাদেশে আসতে চাইলে তাকে বাঁধা দেওয়ার কোনো গ্রাউন্ড নেই।
তিনি এর আগেও বাংলাদেশে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে সময় ইসলামপন্থীদের একটি অংশের প্রবল প্রতিরোধের মুখে আসেননি। তবে এবার অনেকটা চুপিসারেই ঢাকায় এলেন। ঢাকায় পৌঁছে তিনি সামাজিক মাধ্যমে যে ছবি পোস্ট করেছেন তাতেই সবাই জানতে পেরেছে তার আগমনের খবর। ছবিতে সানিকে দেখা গেছে খুবই উৎফুল্ল। বিমানবন্দরে তার সঙ্গে দেখা গেছে তার স্বামী ড্যানিয়েল ও ঢাকায় তার হোস্ট তাপসকে। চরম হাস্যোজ্জ্বল ওই ছবি দেশের অগণিত মানুষের নজরে এসেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ঘুরছে। 

সানি লিওনির আশার খবরে ইসলামপন্থী ওই গ্রুপটি এবারও কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে। তাকে ঘিরে দেশে কোনো ধরণের অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে এজন্য তাকে আমন্ত্রণকারী ব্যক্তিবর্গই দায়ী থাকবেন বলে হুশিয়াঁরি দিয়েছেন। তাকে জরুরি ভিত্তিতে ঢাকা ছাড়ার আল্টিমেটামও দিয়েছে ওই গোষ্ঠীটি। তাদের দাবি ৯৫ ভাগ মুসলমানের এই দেশে একজন পর্ণস্টারের আগমন রীতিমত  জাহেলীপণা-কেয়ামতের আলামত। তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা ঈমান-আকীদা রক্ষায় জিহাদেরই নামান্তর। 

দেশের সরাসরি ইসলামী রাজনীতি করে এমন সংগঠনের চেয়ে ফেসবুকে তাকে নিয়ে অনেক ‘ধর্মরোগী’র উদ্বেগ আরো বেশি। অনেকের মন্তব্য কিংবা পোস্ট পড়ে মনে হয়েছে সানি লিওনির বাংলাদেশে আসার কারনে দেশের যুব সম্প্রদায় মারাত্মকভাবে বিপথে চলে যাবে-এমন আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কিংবা হাজার হাজার যুবক-যুবতী আগামী কাল থেকেই সানির পুরনো পেশায় নাম লেখাতে শুরু করবেন। একটা শতভাগ মুমিন-মুসলিম সমাজে ব্যাভিচারের সূচনা হতে বুঝি আর দেরি নেই। সবার মধ্যে একটা ত্রাহি অবস্থা। অবশ্য অনেকে আবার এর বিপরীত মত পোষণ করেন এমনও দেখা গেছে। 

সানি লিওনি ঢাকায় আসার আগেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ভিডিও নিয়ে বেশ হৈচৈ শুরু হয়। সেটি এখনো চলছে। ওই ভিডিওতে বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাগ-ডে উদযাপনের একটি বিশেষ মুহূর্ত তুলে ধরা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা ক্যাপল ড্যান্স করেছেন। অনেকটা পশ্চিমা সংস্কৃতির ব্যালে ড্যান্সের আদলে। এই ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পরও এমন তীর্যক মন্তব্য চোখে পড়ছে। দেশের সাধারণ সমালোচক শ্রেণি থেকে শুরু করে অনেক নামি-দামি ব্যক্তিও এই সমালোচনায় শরিক হচ্ছেন। নাচের ওই দৃশ্য দেশের প্রচলিত চিন্তা ধারার বাইরে। যেমনটা বাইরে সানি লিওনির আগমনও। তাই অত্যন্ত যৌক্তিক কারণেই আপনি এই দুটি বিষয়কে এক করতে পারেন। কটু কথা কিংবা গালাগালিও করতে পারেন নির্দ্বিধায়। কেননা আপনি মুসলিম। জন্মসূত্রে আপনি একটি সনদ পেয়েছেন। আপনার বিশ্বাস এই সনদ কাল কেয়ামতের দিন আপনার জান্নাত লাভের পথকে সুগম করবে। তাই এই ধরণের নিরপক্ষীয় ইস্যু এলে আপনার ভেতরের চেতনা জেগে ওঠে। আপনি জিহাদি জজবায় উত্তেজিত হয়ে কোটি মানুষের ঈমান-আক্বীদা রক্ষার মিশন নিয়ে মাঠে নেমে পড়েন। 

আমাদের সমাজে দিনকে দিন ব্যাভিচার বাড়ছে। বাড়ছে রাষ্ট্রীয় অনাচার। যে যেভাবে পারছে অন্যকে ঠকাচ্ছে। রাজনীতিক চোর, চাকুরিজীবী ঘুষখোর, ব্যবসায়ী অসৎ, ভাই ভাইকে ঠকাচ্ছে, বাবা ছেলেকে বঞ্চিত করছে, স্ত্রী স্বামীকে ঠকাচ্ছে, স্বামী স্ত্রীর হক আদায় করছে না, মোটামুটি প্রত্যেকেই কোনো না কোনো ভাবে ঈমান বিনাশী কাজে লিপ্ত। এই প্রত্যেকের মধ্যেই আমার-আপনার অস্তিত্ব বিদ্যমান। অর্থাৎ আজকে আমরা যারা সানি লিওনিকে কাফের আখ্যা দিয়ে তাকে প্রতিহত করতে চাইছি তাদের সবাই এই শ্রেণিভুক্ত। কিংবা যারা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ড্যান্সে ‘গেল গেল সব গেল’ বলে হাহুতাশ করছি তারাও এর বাইরে নই।

সানি লিওনি ঢাকায় এলেন। একটি অনুষ্ঠানে এসে নাচলেন। তার সঙ্গে তার স্বামী ড্যানিয়েলও ছিলেন। একজন পর্ণস্টার স্বামীকে নিয়ে এসেছেন। একবার ভেবে দেখুন বিষয়টি। তার একজন বৈধ স্বামী রয়েছে। শুনেছি তিনি তার আয়ের সিংহভাগই চ্যারিটি কাজে ব্যয় করেন। অনেক পরিবারের তিনিই অন্নের উৎস। কয়েক’শ ছেলে- মেয়েকে তিনি মুম্বাই-দিল্লির নামি-দামি স্কুলে পড়ান। কয়েকটি বাচ্চা দত্তক নিয়ে তাদের নিজ সন্তানের মতো বড় করছেন। তার আয়ের ওপর নির্ভরশীল অনেকগুলো পরিবার। অনেকগুলো মানুষ। অনেকগুলো মানুষের ভবিষ্যত। পর্ণ জীবন ছেড়ে আসার পর তিনি মূল ধারার সিনেমায় ক্যারিয়ার গড়েছেন। পৃথিবীতে অনেক পর্ণস্টার কেবলই পর্ণস্টার থেকেছেন। কিন্তু সেখানে সানি লিওনিই হয়তো একমাত্র ব্যতিক্রম যিনি সেখান থেকে বেরিয়ে একটি বৈধ পেশায় ঢুকেছেন এবং সেখানে নিজের একটি অবস্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছেন।  একজন বিধর্মীর কাছে হয়তো এটাই জীবন। জীবনকে উপভোগ করা। নিজে খুশি থাকা, অন্যের খুশির কারণ হওয়া। কেননা তার ঈমানে জান্নাত-জাহান্নাম বিষয়ক আলাদা কোনো বিষয়ের অস্তিত্ব নেই।

সানি লিওনির পূর্ব ও বর্তমান পেশা নি:সন্দেহে ইসলাম স্বীকৃত নয়। তার জন্য সেটা প্রযোজ্যও নয়। কেননা তিনি অমুসলিম। তাই তিনি কোন পেশা বেছে নেবেন সেটি একান্তই তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এটি আপনি-আমি নির্ধারণ করে দিতে পারি না। আর বিশ্বায়নের এই যুগে একজন বৈধ পার্সপোর্টধারী ব্যক্তি যে কোনো দেশেই যাবার অধিকার রাখে। সে যদি কোনো রাষ্ট্র কিংবা ব্যক্তির জন্য হুমকি না হয় তবে তাকে বাঁধা দেওয়ার এখতিয়ার কারো নেই। সেক্ষেত্রে আপনার ঈমান থাকলো না চলে গেল সেটি দেখাও তার কাজ নয়। তাই সানি লিওনিকে নিয়ে নয়। আগে নিজেকে নিয়ে ভাবুন। আপনি বুকে হাত দিয়ে বলুন, আপনি উপরে বর্ণিত শ্রেণিভুক্ত নন। আগে আপনি বলুন আপনি নিজে আল্লাহর কোরানকে পরিপূর্ণভাবে মানেন। আগে আপনি নিশ্চিত হন যে, আপনি নিজেকে যে ধর্মের লোক বলে দাবি করেন সেই ধর্মের চেতনাকে শতভাগ ধারণ করেন। আপনার চিন্তা, কথা ও কাজের মধ্যে আল কোরআনের ম্যাসেজের মিল রয়েছে। যদি সেটি আপনি নিশ্চিত না হতে পারেন তবে প্লিজ সানি লিওনিকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন না।

কেননা তিনি যা করেন তার বিশ্বাস থেকেই করেন। তার হিসাব তিনিই দিবেন। তিনি বাংলাদেশে আসায় কেন প্রতিবাদ করেননি আমার বিশ্বাস কেয়ামতের দিন সে জন্য আপনি জিজ্ঞাসিত হবেন না। বরং আপনার কাছে কোরআন থাকার পরও কেন আপনি শরিকের হক ঠকিয়েছেন, কেন আপনি ঘুষ-উপরি খেয়েছেন, কেন এতিমদের সম্পদ মেরে দিয়েছেন, কেন অবৈধভাবে মুনাফা লুটেছেন, কেন রাষ্ট্রীয় জুলুমের বিরুদ্ধে কথা বলেননি, কেন সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সাধ্য অনুযায়ি ভূমিকা রাখেননি, কেন কোরআন অনুযায়ি একটি সমাজ ব্যবস্থা পরিচালনায় আপনি নীরব ছিলেন। এমন অসংখ্য বিষয় রয়েছে যেগুলো সম্পর্কে কেবল আপনাকেই প্রশ্ন করা হবে। এইসব প্রশ্নের হিসেব দিয়েই সেদিন পার পাবেন না। সুতরাং একটুও টেনশন করবেন না যে, এতোসব প্রশ্নের উত্তর না জানার পরও আপনাকে আল্লাহ তায়ালা সানি লিওনির বিষয়ে প্রশ্ন করতে যাবেন। তাই সানি লিওনি পরে, আগে নিজেকে সামলান। 

লেখক: সাংবাদিক ও কথাশিল্পী।
 

রেডিওটুডে নিউজ/এমএস

সর্বশেষ

সর্বাধিক সবার কাছের