
দেশে একীভূতকরণের আলোচনায় রয়েছে এমন কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক তীব্র আর্থিক সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, এসব ব্যাংকের গ্রাহকরা নিজেদের জমানো টাকা তুলতে পারছেন না। নানা তালবাহানা আর অজুহাত দেখাচ্ছে ব্যাংকগুলো। ফলে চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন গ্রাহকগণ। তাদের মধ্যে বাড়ছে উদ্বেগ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক হতে এসব বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে বড় আকারে তারল্য সহায়তা দেওয়ার পরেও অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের পাঁচটি দুর্বল ব্যাংককে একত্রিত করে একটি শক্তিশালী শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক গঠনের পরিকল্পনা করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কিছু ব্যাংকের অনিয়ম, দুর্বল ব্যবস্থাপনা এবং মার্জার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার কারণে গ্রাহকের আস্থা ফিরে আসেনি। এর প্রমাণ পাওয়া যায় ব্যাংকগুলোতে আমানত প্রবাহে ধীরগতির তথ্যে। জুন মাসেও আমানতে প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশের নিচে ছিল। স্বাভাবিক সময়গুলোতে ৯ থেকে ১০ শতাংশ বা তার বেশি হারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে আমানত বৃদ্ধি পেত। ২০২৪ সালের জুনে আমানতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ২৫ শতাংশ। এরপর থেকেই এই প্রবৃদ্ধি ক্রমাগত নিম্নমুখী ধারায় আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ব্যাংকে তারল্য সংকট কমাতে এবং লেনদেন স্বাভাবিক করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে জুলাইয়ে রেকর্ড পরিমাণে বিশেষ তারল্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে। ঐ মাসে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ৪ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকার বিশেষ তারল্য সহায়তা দেওয়া হয়। জুনে বিশেষ তারল্য সহায়তা বাবদ দেওয়া হয়েছিল ৩ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত দেওয়া বিশেষ তারল্য সহায়তার মধ্যে গত জুলাইয়ে দেওয়া সহায়তাই সর্বোচ্চ।
সূত্র জানায়, বিগত সরকারের সময়ে ব্যাংক খাতে লুটপাটের কারণে সৃষ্ট ক্ষত আরও প্রকট হচ্ছে। যে কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। এখন ব্যাংকগুলোয় খেলাপি ঋণ ৫ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ফলে ব্যাংকগুলোর সম্পদের মান খারাপ হচ্ছে। এর বিপরীতে তারল্য সংকট বাড়ছে। তারল্য সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো যেমন আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না, তেমনই গ্রাহকদের চাহিদামতো ঋণও বিতরণ করতে পারছে না। আগে বিতরণ করা ঋণ খেলাপি হওয়ায় এবং নতুন ঋণ বিতরণ কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর আয়ও কমে যাচ্ছে। এতে স্বাভাবিক লেনদেন করতে পারছে না। তবে এর বিপরীত চিত্রও রয়েছে। কিছু বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক আমানত সংগ্রহ আগের সময়ের তুলনায় রেকর্ড গড়ে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, কয়েকটি দুর্বল ব্যাংকের প্রভাব পড়ছে পুরো ব্যাংকিং সেক্টরে। কিছু ব্যাংক খেলাপি আদায়, ঋণ বিতরণে ভালো করলেও সার্বিক চিত্রে উঠে আসছে না।
ইতিমধ্যে দুর্বল পাঁচ শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক মিলে একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার রূপরেখার খসড়া তৈরি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এই পাঁচ ব্যাংকের আমানত ধারাবাহিকভাবে কমে গত মে পর্যন্ত ১ লাখ ৩৬ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকায় নেমেছে। গত বছরের মার্চ পর্যন্ত মোট আমানত ছিল ১ লাখ ৪৬ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা। আর গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছিল ১ লাখ ৫৮ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে পাঁচটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা। মোট ঋণের যা প্রায় ৭৭ শতাংশ। বিপুল অঙ্কের এ খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, আমানতকারীদের আস্থা ফেরানোই একীভূতকরণ উদ্যোগের প্রধান লক্ষ্য। যে কারণে নতুন ব্যাংকটিকে নানাভাবে সহায়তা এবং ছাড় দেওয়া হবে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, দুর্বল ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণের চলমান প্রক্রিয়া নিয়ে আমানতকারীদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় প্রয়োজনীয় সব দায়িত্ব সরকার গ্রহণ করবে।
রেডিওটুডে নিউজ/আনাম